:
শিরোনাম

প্রতিবেশী দেশের সম্পর্ক এগিয়ে নিতে তাঁদের মধ্যে ঐকমত্য হয়েছে।

top-news
https://maannews.acnoo.com/public/frontend/img/header-adds/adds.jpg

বাংলাদেশে ৫ আগস্টের পর ভারতের সঙ্গে টানাপোড়েন আর উত্তেজনার প্রেক্ষাপটে সোমবার ঢাকায় বৈঠকে বসেছিলেন দুই দেশের পররাষ্ট্রসচিবেরা। সম্পর্কের ইতিহাসে বিরল এই টানাপোড়েন আর আস্থার সংকট কাটাতে পররাষ্ট্রসচিব মো. জসীম উদ্দিন ও ভারতের পররাষ্ট্রসচিব বিক্রম মিশ্রি সে দিন তিন ঘণ্টার বেশি খোলামেলাভাবে একে অন্যের কথা শুনেছেন। নিজেদের উদ্বেগের বিষয়গুলো শুনে দুজনে নিজেদের যুক্তিও দিয়েছেন। শেষ পর্যন্ত পরিবর্তিত প্রেক্ষাপটে দুই প্রতিবেশী দেশের সম্পর্ক এগিয়ে নিতে তাঁদের মধ্যে ঐকমত্য হয়েছে।দুই দেশের সম্পর্কের ভবিষ্যতের স্বার্থে ড. ইউনূসের নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে কাজ করার প্রত্যয় ব্যক্ত করেছে ভারত। টানাপোড়েনের মধ্যেও বিক্রম মিশ্রির এই সফরকে সম্পর্কের বাধা দূর করার ‘প্রতীক’ হিসেবে দেখছে বাংলাদেশ। সম্পর্ককে ইতিবাচক ও গঠনমূলকভাবে এগিয়ে নিতে তিনি যে অঙ্গীকার করেছেন, তার প্রতিফলন দেখার অপেক্ষায় বাংলাদেশ।দুই দেশের সম্পর্কের সাম্প্রতিক প্রেক্ষাপটের কারণে এবারের পররাষ্ট্রসচিবের বৈঠকের প্রক্রিয়া এবং বিষয়বস্তুতে ছিল ভিন্নতা। সাধারণত দুই দেশের পররাষ্ট্রসচিবেরা প্রতিনিধিদের নিয়ে আলোচনার টেবিলেই সব বিষয়ে কথা বলে থাকেন। এবার চিরাচরিত সেই আলোচনার পরিবর্তে তাঁদের দুজনের মধ্যেই বেশি কথাবার্তা হয়েছে। এর পাশাপাশি ইস্যুভিত্তিক আলোচনার পরিবর্তে সম্পর্কের রাজনৈতিক মাত্রার বিষয়গুলো প্রাধান্য পেয়েছে। রাজনৈতিক মাত্রার বিষয়টি দুজনে এক দফায় আলোচনা করে প্রতিনিধি পর্যায়ের বৈঠকেও তুলেছেন।

গত সোমবার সকালে রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন পদ্মায় বিক্রম মিশ্রিকে স্বাগত জানান জসীম উদ্দিন। এরপর তিনি আলোচনার প্রক্রিয়া কীভাবে এগোবে, তা নিয়ে বিক্রম মিশ্রিকে জানান। দুজন খোলামেলাভাবে গত চার মাসে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক যেখানটায় এসে দাঁড়িয়েছে, তা নিয়ে কথা বলেন। এ সময় একে অন্যের অবস্থান তুলে ধরেছেন দুজনই। উদ্বেগ আর অস্বস্তির কথা বলেছেন এবং শুনেছেন। এর পাশাপাশি দুজনই দুজনের উদ্বেগের জবাবে নিজেদের দৃষ্টিকোণ থেকে বাস্তবতার কথা বলেছেন। সব শেষে তাঁরা বাধা পেরিয়ে সম্পর্ক এগিয়ে নেওয়ার কথা বলেছেন বলে জানা গেছে।

বিক্রম মিশ্রির সঙ্গে জসীম উদ্দিনের আলোচনায় উপস্থিত একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে এমন ধারণা পাওয়া গেছে যে বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের ওপর হামলার কথা বলে ভারতের গণমাধ্যম আর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অপতথ্যের বিস্তার, আগরতলার বাংলাদেশ মিশনে হামলা—সব মিলিয়ে এ মাসের শুরুতে অস্থিরতার মাত্রা হঠাৎ করেই বাড়তে দেখা যায়। এর রেশ ধরে ঢাকায় ভারতীয় হাইকমিশনারকে তলব করা হয় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে। ২ ডিসেম্বর ত্রিপুরায় হিন্দুত্ববাদী সংগঠনগুলোর হামলার প্রতিবাদ জানিয়ে ওই দিনই বাংলাদেশ কড়া বার্তা পাঠায় ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে। সব মিলিয়ে এমন এক উত্তেজনা আর অস্বস্তির মধ্যে শেষ পর্যন্ত বিক্রম মিশ্রির ঢাকা সফরকে প্রতীকীভাবে ইতিবাচক মনে করছে বাংলাদেশ। এই সফরের ধারাবাহিকতায় সামনের দিনগুলোতে নানা পর্যায়ে বৈঠকগুলো অনুষ্ঠিত হলে বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের যুক্ততার সদিচ্ছার প্রমাণ মিলবে।

সোমবার দুই পররাষ্ট্রসচিবের আলোচনার শুরুতে বাংলাদেশ দুই প্রতিবেশী দেশের সম্পর্কের গুরুত্ব, তাৎপর্য এবং আন্তর্জাতিক পরিসরে নানাভাবে একে অন্যকে সহায়তার প্রসঙ্গগুলো তোলে বলে জানা যায়। এরপর সংগত কারণেই এসে যায় ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর জন–আকাঙ্ক্ষার বিষয়গুলো। ৫ আগস্টের পর রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিসরে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কের বিষয়গুলো নিয়ে বাংলাদেশের মানুষের প্রশ্নগুলো সামনে এসেছে বড় করে। এ সময় ভারতের পক্ষ থেকে বলা হয়, বাংলাদেশের একটি ‘বিশেষ রাজনৈতিক দলের’ সঙ্গে ভারতের সম্পর্কের ধারণাটি ভুল। পাঁচ দশক ধরে বাংলাদেশের সব সরকারের সঙ্গেই ভারত সম্পর্ক বজায় রেখে সম্পর্ক এগিয়ে নিয়েছে। বাংলাদেশে উন্নয়ন প্রকল্পসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিনিয়োগগুলো বাংলাদেশের জনগণের স্বার্থে। ভারত ভবিষ্যতেও বাংলাদেশের জনগণের স্বার্থে এমন বিনিয়োগ অব্যাহত রাখবে। এ সময় বাংলাদেশের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, গত ১৫ বছরে দুই দেশের সম্পর্ক যেভাবে এগিয়েছে, তাতে মানুষের মতামতকে উপেক্ষা করে আওয়ামী লীগই নিজের মতো করে এগিয়ে নিয়েছে। তাই মানুষ এটা নিয়ে অনবরত প্রশ্ন তুলছে।

দুই পররাষ্ট্রসচিবের আলোচনায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারতে অবস্থান নিয়ে বাংলাদেশের বিরক্তি আর অস্বস্তির কথা সরাসরি তোলেন জসীম উদ্দিন। শেখ হাসিনার ভারতে বসে বিভিন্ন বক্তৃতা ও রাজনৈতিক তৎপরতা যে বাংলাদেশ পছন্দ করছে না, সেটা জানাতে বিক্রম মিশ্রিকে অনুরোধ করেন জসীম উদ্দিন। বিক্রম মিশ্রি এ সময় জসীম উদ্দিনকে বলেছেন, শেখ হাসিনা দুই দেশের সম্পর্কে কোনো বাধা হয়ে দাঁড়াবেন না।

দিল্লিতে বসে শেখ হাসিনার রাজনৈতিক তৎপরতার রাশ টানতে ভারত আদৌ কোনো ব্যবস্থা কি শেষ পর্যন্ত নেবে! এমন প্রশ্নের উত্তরে এক কূটনীতিক বলেন, বাংলাদেশ বলার সঙ্গে সঙ্গেই ভারত তার দীর্ঘদিনের ঘনিষ্ঠ মিত্রের পথ আটকে দেবে—এমনটা ভাবার কোনো কারণ নেই। তবে বাংলাদেশ যে বিষয়টা পছন্দ করছে না আর ভবিষ্যতেও বিষয়টি বাদ দেবে না, এই বার্তা তাদের স্পষ্টভাবে দেওয়া হয়েছে।

রাজনৈতিক পরিসরে আলোচনা করতে গিয়ে ভারতীয় গণমাধ্যমে মিথ্যা আর অপপ্রচারের ফল যে ত্রিপুরার বাংলাদেশ মিশনে হামলা, সেটি সেদিন বাংলাদেশ জোরালোভাবে বলেছে। ফলে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার স্বার্থেই ভারতীয় গণমাধ্যমের নেতিবাচক ধারা থেকে বের হওয়ার কথা বলে বাংলাদেশ। এ সময় বাংলাদেশ প্রাসঙ্গিকভাবে বলেছে, বাংলাদেশের গবেষক, বিশ্লেষক, গণমাধ্যমকর্মীসহ অনেকেই ভারতের গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোতে যুক্ত হয়ে বাস্তব ছবিটা তুলে ধরার অনবরত চেষ্টা করেছেন। অথচ বাংলাদেশের লোকজনকে যেভাবে প্রশ্ন করা হয়েছে বা আলোচনার মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে যে বক্তব্য ভারতের গণমাধ্যমগুলো প্রচার করছে, তাতে স্পষ্ট যে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে একধরনের ‘বয়ান’ জারি করতে আগ্রহী একটি পক্ষ। এ সময় ভারতের পক্ষ থেকে বলা হয়, ৫ আগস্টের পর বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিসর থেকে ভারত সম্পর্কে নেতিবাচক মন্তব্য এসেছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অব্যাহতভাবে এর প্রতিফলন ঘটেছে। বাংলাদেশ তখন বলেছে, শুরুতে কিছু বক্তব্য–বিবৃতি এলেও সময় গড়ানোর সঙ্গে বাংলাদেশে এই প্রবণতা বন্ধ হয়ে গেছে। ভারতের পক্ষ থেকে আলোচনায় ধানমন্ডিতে ইন্দিরা গান্ধী সাংস্কৃতিক কেন্দ্রে হামলার বিষয়ে উদ্বেগ জানানো হয়।

দুই পররাষ্ট্রসচিবের বৈঠকে উপস্থিত বাংলাদেশের বেশ কয়েকজন কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে এমন ধারণা পাওয়া যায় যে আপাতত বিক্রম মিশ্রির ঢাকা সফরকে তাঁরা ইতিবাচক হিসেবে দেখছেন। পররাষ্ট্রসচিব মো. জসীম উদ্দিন গতকাল বুধবার প্রথম আলোকে বলেন, দুই দেশের সম্পর্কে যে অনাস্থার বিষয়টি তৈরি হয়েছে, তা কাটাতে এ সফরকে ইতিবাচক উদ্যোগ হিসেবে ভালো সূচনা বলা যায়। এখন এর ধারাবাহিকতায় আগামী দু–তিন মাসে যদি নানা পর্যায়ের কয়েকটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়, তাহলে দুই দেশের সম্পর্ক ইতিবাচকভাবে এগোতে পারে। এটি ঘটলে আগামী বছর যেকোনো সময় ঢাকায় পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেনের সঙ্গে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্করের বৈঠকের পথ সুগম হতে পারে। এ জন্য ঢাকায় এসে বিক্রম মিশ্রি সম্পর্ক এগিয়ে নেওয়ার যে ‘প্রত্যয়’ করে গেছেন, বাস্তবে তার প্রতিফলন দেখতে চায় বাংলাদেশ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *